স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ রচনা

স্বাধীনতার অর্থ সর্বপ্রকার পরাধীনতার বন্ধন থেকে মুক্তি। আজকাল আমরা স্বাধীন বলতে কোন বিদেশী শক্তির কবল থেকে মুক্ত হওয়াকে বলি। একে রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলা হয়। আমরা বাঙালি জাতি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশের অধীনে ছিলাম। ১৯৪৭ সালে আমরা স্বাধীন হয়ে স্বাধীন পাকিস্তানকে পায়। পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। দুটি অংশ ছিল প্রায় এক হাজার মাইল দূরত্বে। এই পাকিস্থানের শতকরা ৫৬ জন ছিল বাঙালি আর শতকরা ৪৪ জন ছিল উর্দু, পাঞ্জাবি, পস্তু ওসিন্ধি ভাষাভাষী।

পাকিস্তান অর্জিত হওয়ার পর থেকে আমরা ওই পাঞ্জাবি বা পশ্চিম পাকিস্তানের কবলে পড়ি। আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি ছিল না। যে পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ জন পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করত তা তারা ভোগ করা থেকে বঞ্চিত ছিল। দিনে দিনে বাঙালি বেদনা- দুঃখে উত্তেজিত হতে থাকে। তারপর ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে বাঙালি ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করে।

বৃক্ষলতা আপনি আপনি বৃক্ষলতা। কিন্তু মানুষ সহজে মানুষ নয়। মানব জীবনকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে তুলতে দরকার সামাজিক মূল্যবোধ, দরকার মনুষত্ব অর্জন। মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ব প্রসঙ্গে কাজী মোতাহের হোসেন চৌধুরী যথার্থই বলেছেন,” জীবন বৃক্ষের শাখায় যে ফুল ফোটে, তাই মনুষ্যত্ব। বৃক্ষের গোড়ায় জল ঢালতে হবে এই ফুলের দিকে নজর রেখে। শুধু শুধু মাটির রস টেনে গাছটা মোটা হয়ে উঠবে এই ভেবে কোন মালিক গাছের গোড়ায় পানি ঢালে না। মানুষকে খাইয়ে দাইয়ে মোটা করে তুলবার জন্য নয়, মানুষের অন্তরের মূল্যবোধ তথা সৌন্দর্য, প্রেম ও আনন্দ জাগিয়ে তুলবার উদ্দেশ্যে, তবে সমাজ ও জীবন সুন্দর হবে। সামাজিক মূল্যবোধহীন সমাজ- বর্বর সমাজ, অসভ্য সমাজ। এরূপ সমাজ ও জীবন মানুষের কাম্য নয়। সমাজ ব্যবস্থাকে ঠিক করতে হবে। তাই সামাজিক মূল্যবোধের চর্চা করা অপরিহার্য।”

স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। কেউ অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে সে বিদ্রোহী হয়ে উঠে। নিজের স্বাধীনতা হয় ছিনিয়ে নেয়, না হয় স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাক্ষী বাংলাদেশ। নয় মাস অবিরত যুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করে আজ এদেশের আকাশে স্বাধীনতার বিজয় পতাকা উঠছে পৎপৎ করে। আজ আমাদের দেশ স্বাধীন হলেও আমরা ভুলে গেছি স্বাধীনতা অর্থ উচ্ছৃঙ্খলা বা স্বেচ্ছাচারিতা নয়, স্বাধীনতা ভোগের জন্য। অন্যের স্বাধীনতা যেন বিঘ্নিত না হয় সেদিকে সকলের স্মরণ রাখা উচিত। আমি স্বাধীন এ কথার অর্থ এই নয় যে, আমি বা আমার যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। আমাদের স্বাধীনতার জন্য অন্যের ক্ষতি হোক এমন স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছাচারিতা বলে আইনের মাধ্যমে আমরা যার যার অধিকার ভোগ করব।

স্বাধীনতা অর্জন করা যতটা সহজ রক্ষা করা এর চেয়েও অনেক কঠিন। দেশবাসীকে স্বদেশপ্রেমিক হয়ে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে মজবুত করে গড়ে তুলতে হবে। দেশের সার্বিক ক্ষেত্রে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সকলকে সুখী করতে হবে। দেশের সার্বিক উন্নয়ন কাজকর্মে সমানভাবে অংশ নিয়ে দেশের উন্নতির জন্য এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়বে। দেশের অগণিত মানুষ অশিক্ষায় -কুশিক্ষায় ভুগছে, রোগে তাদের ওষুধ জোটে না, দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় না। এসব মানুষকে সাহায্য করতে হবে সকলের সমান অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। তবেই তো স্বাধীনতা অর্থবহ হবে।

আবার দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করতে হবে, না হলে দেশ ও জাতির মুক্তি কখনো সম্ভব হবে না। পরিশেষে কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলেন, মানুষের সভ্যতা যতদূর উন্নত হয়েছে ততদূর সফল হয়েছে মানুষের বিবেক, তাই বিবেক দ্বারা নির্মিতার বিশ্ব যেন অবিবেকের দ্বারা আক্রান্ত বা ধ্বংস না হয় সেদিকে সবার মনোযোগ দিতে হবে। বিবেকবান আগামী বিশ্ব আমাদের সকলের কাম্য হওয়া উচিত।