স্বদেশ প্রেম রচনা

স্বদেশ মানুষের কাছে পরম সাধনার ধন, নিশ্চিন্ত নিবাস। স্বদেশের মানুষ স্বদেশের রূপ- প্রকৃতি, তার পশু পাখি, এমনকি তার প্রতিটি ধূলিকণা সবার কাছে প্রিয় ও পবিত্র। অন্ন- পানি দিল, বস্ত্র দিল তার প্রতি যদি সেই শ্যামল স্নেহে প্রতিপালিত সন্তানদের মমতামন্ডিত আনুগত্য না থাকে, তবে তারা কেবল অকৃতজ্ঞ নয়, বিশ্বের সকল জঘন্য বিশেষণে বিশেষিত। স্বদেশ প্রেম মানুষের একটি শ্রেষ্ঠ গুণ। যে দেশে আমরা জন্মগ্রহণ করি তাকে জন্মভূমি বলে। একটি মানুষের নিকট জননির মতই প্রিয় জন্মভূমির প্রতিটি ধূলিকণা কে নিজ দেহের প্রতিটি কোষ মনে করে তাকে ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধাবোধ দেখানোই হচ্ছে দেশ প্রেম বা স্বদেশ প্রেম। স্বদেশপ্রেম মানুষের ভিতর জন্ম দেয় মহৎ হওয়ার গুণাবলী। এ গুণাবলী মানুষকে করে তোলে শ্রেষ্ঠ।

নিজেকে ভালোবাসে না এমন লোক পৃথিবীতে একজনও নেই। নিজের প্রতি ভালোবাসা থেকে জন্ম নেয় দেশের প্রতি ভালোবাসা। সৃষ্টির প্রতিটি জীবের মধ্যে এই গুণটি বিদ্যমান। যেমন কোন বন্য পশুকে লোকালয়ে নিয়ে আসলে সে বনে ফিরে যাবার জন্য ছটফট করে, তেমনি কোন পাখিকে নীড় থেকে নিয়ে আসলে তার মর্মভেদি আর্তনাদ বাতাসকে ভারী করে তোলে। এটাও নিজের অভ্যাসের প্রতি ভালোবাসার কারণ। এই অভ্যাসের প্রতি ভালোবাসা থেকে জন্ম নেয় দেশের প্রতি ভালোবাসা।

স্বদেশের প্রতি আমাদের ভালবাসা প্রকাশ পায় স্বদেশের বিপর্যয়ের মুহূর্তে। দেশের দুর্দিনে দেশ প্রেমের পূর্ণবিকাশ ঘটে। স্বদেশের পরাধীনতায়, স্বদেশের উপর হামলায়, স্বদেশের মুখে কলঙ্ক লেপনের সময় মানুষের মধ্যে স্বদেশ প্রীতি জাগ্রত হয়ে উঠে, তখন জন্মভূমি জননীর মতো সন্তানের দিকে কাতর নয়নে তাকায় আর জননির বেদনায় সন্তানের হৃদয় হয় বিদীর্ণ। জলাশয় থেকে বিচ্ছিন্ন করলে মাছ যেমন জলের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে, তেমনি প্রবাসী জীবনে মানুষের ভিতর স্বদেশ প্রীতি মূর্ত হয়ে ওঠে।

স্বদেশ প্রেম দেশ ও জাতির গৌরবের বস্তু। কিন্তু অন্ধ স্বদেশপ্রেম ধারণ করে ভয়ঙ্কর রূপ। জাতিতে জাতিতে সংঘাত ও সংঘর্ষ অনিবার্য করে তোলে অন্ধ স্বদেশপ্রেম। আমরা স্বদেশের জয়গান গাইতে গিয়ে যদি অপরের স্বদেশ প্রেমকে আহত করি, তবে সেই স্বদেশ প্রেম বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে ডেকে নিয়ে ভয়াবহ রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। হিটলারের জার্মান দখল কিংবা মুসোলিনির ইতালি উগ্র জাতীয়তাবাদের নগ্ন রূপ। চলমান বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্র কর্তৃক দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের প্রতি আগ্রাসী মনোভাব অন্ধ স্বদেশপ্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ।

মূলত রাজনীতিবিদদের প্রথম ও প্রধান শর্ত হল দেশপ্রেম। স্বদেশ প্রেমের পবিত্র বেদিমুলে রাজনীতির পাঠ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রাজনীতিবিদ দেশের সদা জাগ্রত প্রহরী। পরাধীন বাংলাদেশের দিকে দিকে যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছিল তাদের সকলেরই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পরাধীনতার শিখল থেকে দেশ জননীকে শৃখলমুক্ত করা। তাদের অবদানে আজ দেশ স্বাধীন। আজও দেশের বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দল বর্তমান। রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে এখনো কত নতুন দলের আবির্ভাব ও নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু আজ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই মহত্তর, বৃহত্তর কল্যাণবোধ থেকে পথভ্রষ্ট। নিজস্ব স্বার্থ চিন্তাই অনেক ক্ষেত্রে প্রবল। দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে, মানুষের প্রয়োজনে সর্বত্র বিলিয়ে দেওয়ার সাধনা দেশপ্রেমের অঙ্গীকার ও সার্থকতা। এখন এগুলো প্রায়ই অনুপস্থিত। রাজনীতিসর্বস্ব দেশ প্রেম প্রকৃতপক্ষে ধ্বংস ও সর্বনাশের পথকেই প্রশস্ত করে।

যুগে যুগে অসংখ্য মনীষী দেশের মানুষের কল্যাণে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এ উপমহাদেশে ক্ষুদিরাম, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, চীনের মাও সেতুঙ, জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ ব্যক্তি বিশ্ব অঙ্গনে দেশ প্রেমের ক্ষেত্রে নিজ নিজ মহিমায় ভাস্বর। বাঙালি জাতির দেশপ্রেমও বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করেছে। তারা নয় মাস যুদ্ধ করে প্রায় ৩০ লাখ সোনার সন্তানের জীবন বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনে দেশপ্রেমের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। জাতি- ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষকে ভালবাসতে হবে। অর্জন করতে হবে মানব প্রীতির গুণ। তবেই দেশের প্রকৃত কল্যাণ সাধিত হবে। আর প্রকৃত দেশপ্রেমিকও হয়ে উঠবে বিশ্ববরেণ্য মহৎপ্রাণ ব্যক্তি। কারণ দেশপ্রেম নামক মহান গুণাবলীই মানুষকে পরম পূজনীয় করে তুলে।