মানব কল্যাণে বিজ্ঞান রচনা

সভ্যতার সূচনাকালে মানুষ ছিল অরণ্যচারী, গুহাবাসী। ক্রমে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ, জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে সে হয়ে উঠলে প্রভুত ক্ষমতার অধিকারী। আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে কুসংস্কার থেকে দিয়েছে মুক্তি। এনেছে অন্ধকার থেকে আলোকে। দিয়েছে নতুন জীবন। মানুষের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি বিজ্ঞানের বিচিত্র পথে গমন করে মানব জীবনে জন্য এনেছে পরম কল্যাণ। বিজ্ঞান ঘুচিয়ে দিয়েছে দূর দূরান্তের ব্যবধান। মানুষকে দিয়েছে ক্ষমতা। জীবন কে করেছে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যময়। বিজ্ঞানের কল্যাণে গোটা পৃথিবী আজ মানুষের হাতের মুঠোয়।

সেই আদিম যুগে গোষ্ঠীবদ্ধ যাযাবর মানুষের জীবনে যোগান্তর আনে আগুনের আবিষ্কার আর কৃষির উদ্ভাবন। সে সময় গড়ে উঠলো ছোট ছোট গ্রাম। উদ্ভাবিত হলো আদি কৃষিযন্ত্র লাঙ্গল। মানুষ খেতে জলছেচের জন্য তার বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে, সেগুলো সংরক্ষণ করে ফসল থেকে আরো নানা প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করতে শিখলো। কুমারেরা চাকা ঘুরিয়ে বানাতে শুরু করলে মাটির পাত্র। সে সময় শিল্পের উদ্ভব ঘটে। ভারী জিনিস সহজে উত্তোলন করার জন্য সে সময় মানুষ কপিকল আলম্ব প্রভৃত যন্ত্র তৈরি করেছিল।

নল খাগড়া থেকে মিশরের মানুষ প্রথম লেখার উপযোগী কাগজ তৈরি করে। ইরাক অঞ্চলের মানুষেরা প্রথম চাকাযুক্ত গাড়ি তৈরি করে পরিবহন ব্যবস্থার যুগান্তর আনে। পানি তোলার উপযোগী বিশেষ ধরনের পাম্প এবং যন্ত্র চালিত ঘড়ি প্রথম আবিষ্কৃত হয় চীন দেশে। গ্রিসের মানুষ প্রথম পৃথিবী ও মহাকাশের মানচিত্র আঁকে। প্রাণিবিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র, স্থাপত্যবিদ্যা ও জ্যামিতির ক্ষেত্রে গ্রিক বিজ্ঞানীদের অবদান কম ছিল না। অন্যদিকে বীজগণিত, জ্যোতির্বিদ্যা শল্যচিকিৎসা, রসায়নশাস্ত্র, জীব বিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রাচীন ভারত, আরব দেশের বিজ্ঞানীরা যেসব তথ্য উদ্ভাবন করেছিলেন, তা মানুষের জীবনযাত্রাকে যথেষ্ট সহজ করে দেয়।

প্রাগৈতিহাসিক মানুষের আগুন আবিষ্কারের দিন থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত মানুষের অতন্দ্র সাধনা বিজ্ঞান কে করেছে সমৃদ্ধ। সভ্যতাকে করেছে গতিশীল। বাষ্প শক্তিকে সে করেছে বশীভূত। বিদ্যুৎ কে করেছে করায়ত্ত্ব। মুঠোয় পুরে নিয়েছে পারমাণবিক শক্তি। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মানুষের প্রতিটি কর্মকান্ডের সঙ্গে এই বিজ্ঞান জড়িত।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই বিজ্ঞানের প্রভাব বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী। ঘরে-বাইরে, পথে- ঘাটে, অফিসে- আদালতে, অনুষ্ঠানে, আমাদের সংবাদের সংলাপে সর্বত্রই বিজ্ঞান। জাগরন থেকে শুরু করে নিদ্রাকর্ষণ পর্যন্ত সর্বত্র বিজ্ঞানের স্পর্শ। টুথপেস্ট, টুথব্রাশ, স্টভ, হিটার, বৈদ্যুতিক পাখা, ফ্রিজ, এয়ার কুলার, লিফট, কম্পিউটার, তেল, সাবান, পাউডার, পারফিউম, আয়না ইত্যাদি ছাড়া জীবন যাপনের কথা চিন্তাই করা যায় না। আমোদ-প্রমোদের ক্ষেত্রে ও বিজ্ঞান আমাদের নির্ভর স্থল। টেলিভিশন, ডিস এন্টেনা এখন গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে দেখা যায়। গৃহ কার্যের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস বিজ্ঞানের আবিষ্কার।

জনসংখ্যার সমস্যা বিশ্বের এক নম্বর সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ও বিজ্ঞানের আবিষ্কার। বিজ্ঞানের বদৌলতে আমরা অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে সবকিছু খোলা চোখে বিচার করতে পারছি। বিজ্ঞানের কারণে আমাদের মন যুক্তিবাদী হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞান আধুনিক মানুষকে চলার পথে গতি দিয়েছে। শক্তি দিয়েছে তাকে করেছে যুক্তিবাদী।

বিজ্ঞানের কল্যাণকর আবিষ্কার এর বিপরীতে রয়েছে এক সর্বনাশা ধ্বংসাত্মক রূপ। গত শতাব্দীতে সংঘটিত জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞ মানুষের আদিম প্রবৃত্তির বর্বরতাকে অতিক্রম করেছে। বিজ্ঞানের উচ্চতর প্রযুক্তির ব্যবহার করে মানুষ আজ তৈরি করেছে আণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, জীবাণু বোমা এবং অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র। বিজ্ঞানের ধ্বংসাত্মক শক্তির কাছে হার মেনেছে মানুষ।

আজ বিজ্ঞানের জয় জয়কার সর্বত্র। মানুষের কল্যাণে বিজ্ঞানের দান অপরিসীম। মানুষের সহজ জীবনযাত্রা বিজ্ঞানেরই অবদান। বিজ্ঞানীদের মহৎ আত্মত্যাগের ফলে অর্জিত হয়েছে সাফল্য। তবে আমাদের জীবনে বিজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটাতে হবে এবং বিজ্ঞানের আলোয় সবাইকে আলোকিত হতে হবে। বিজ্ঞানকে যদি ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার না করে মানব কল্যাণে ব্যবহার করা যায়, তবে মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হবে।