বন্য প্রকৃতি মানুষের নিকটতম প্রতিবেশী। বনভূমি পৃথিবীর প্রথম আগন্তুক। মানুষের আগমনের পূর্বে সে এসে মানুষের ক্ষুধা মেটাবার খাদ্য এবং মাথা গুজার শীতল ছায়া সৃষ্টি করে প্রতীক্ষা করেছিল মানুষের আবির্ভাবের। তারপর মানুষের এবং সৃষ্টির সেই প্রথম প্রভাতে মানুষ ভূমিষ্ঠ হয়েছিল সিগ্ধ- শ্যামল অরণ্যের কোলে। অরণ্য তার অবারিত শ্যামল ছায়া বিস্তার করে তাকে সূর্যের প্রখর দহন জ্বালা থেকে রক্ষা করেছিল। তার ক্ষুধার্ত মুখে অরণ্য দিয়েছিল খাদ্য। প্রকৃতির নানা বিরুদ্ধ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য দিয়েছিল নিরাপদ আশ্রয়।
কিন্তু কাল ক্রমে কৃতঘ্ন মানুষ তার সেই পরম স্থিতিশীল অরণ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে কঠোর হাতে কুঠার নিয়ে পৃথিবীকে বৃক্ষহীন করছে। কিন্তু বৃক্ষ না থাকলে মানুষ পৃথিবীতে বসবাস করতে পারতো কিনা সন্দেহ। শুধু মানুষ নয়, গোটা প্রাণী জগতই বিলুপ্ত হয়ে পড়তো। কাজেই বলা যায় বৃক্ষ প্রাণিজগতের জন্য অতিব প্রয়োজনীয়। বৃক্ষকে টিকিয়ে রাখা, নতুন নতুন বৃক্ষরোপন করা, পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বনায়নের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি আজ প্রাণীকুলের অপরিহার্য কর্তব্য। বৃক্ষরোপন অভিযানের মাধ্যমে সেই শুভবোধ মানুষের মনে জাগ্রত হচ্ছে।
অরণ্য হনন যে আত্মহননের নামান্তর, তা এতদিনে মানুষের উপলব্ধি হয়েছে। অরণ্য হরনের ফলে যে একদিন জলহীন, ছায়াহীন, মরুভূমি নেমে আসবে এবং তাতে যে মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে, সেই শুভবোধ আজ মানুষের মনে জাগ্রত হচ্ছে। বৃক্ষরোপণ অভিযান সেই শুভবোধের আনন্দময় প্রকাশ। বৃক্ষ আমাদের নানাবিধ প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বৃক্ষ আমাদের পাকা ফল, জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, পোশাক তৈরির সুতা, বাসগৃহ তৈরীর উপকরণ, আসবাবপত্র তৈরির জ্বালানি ইত্যাদি দিয়ে থাকে। তাছাড়া বন-সম্পদ দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে। এমনকি বৃক্ষ দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করে।
বৃক্ষের সীমাহীন গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করা হলে বাংলাদেশে বনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে প্রতিভাত হবে। বাংলাদেশের বিখ্যাত সুন্দরবন দীর্ঘ ঐতিহ্যের পরিচায়ক। ভাওয়াল, মধুপুর , সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল রয়েছে। কিন্তু ব্যাপকভাবে ও অপরিকল্পিত উপায়ে বনের গাছপালা কেটে ফেলায় সাময়িক বনাঞ্চল কমে যাচ্ছে।
প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য দেশের আয়তনের এক চতুর্থাংশ বনভূমি থাকার কথা। কিন্তু দেশের মোট আট শতাংশ বনভূমি রয়েছে। তাছাড়া প্রতিনিয়ত প্রচুর সম্পদ বিনষ্ট করে ফেলা হয়। এর ফলে দেশে এখন গাছের অভাব ঘটছে। বনাঞ্চল কমে যাচ্ছে। পরিণামে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। বনান্ঞ্চল কমে যাওয়ায় দেশে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে বলে অনুমান করা হয়। এভাবে বৃক্ষের অবসান ঘটলে, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনযোগ্য চলতে থাকলে দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
মানব জীবন ও অরণ্য জীবন প্রাণের এই দুই মহান প্রকাশ এর মধ্যে বাজে একটি মাত্র ছন্দ। ঋতুচক্রের আবর্তনের পথে উভয়ের একই স্পর্শকাতরতা। বসন্তের দক্ষিণ বাতাসে মানুষ তার হৃদয়ের অনুভূতিকে চিত্রের সঙ্গীতে কিংবা কবিতায় প্রকাশ করে। আর অরণ্য তার বাসন্তী বেদনা কে প্রকাশ করে অশোক, পলাশ আর কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম রঙে। উভয়ের আদান-প্রদানের সম্পর্ক ও অতি নিবিড়। এক বিপুল ভ্রান্তিবিলাসের জন্য মানুষ এতদিন তার পরম বন্ধুকে চরম শত্রু মনে করে নির্বোধ ঘাতকের মতো ধ্বংসের পৈশাচিক লীলায় নিতে উঠেছিল। আজ আর বনভূমি ধ্বংস নয়, বনভূমির প্রয়োজন। অরণ্য ছাড়া পৃথিবীর পরিণত হতো মরুভূমিতে। অরণ্যই প্রাণের অগ্রদূত।
বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিকে সফল করার জন্য আমাদের প্রত্যেকের প্রয়োজন প্রতিবছর গাছ লাগানো এবং গাছকে যত্নের সাথে রক্ষণাবেক্ষণ করা। ফলে গাছ থেকে আমাদের প্রয়োজন মেটাতে পারবো। আমরা গ্রিনহাউস ইফেক্ট থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে এবং পরিবেশগত ভারসাম্য ও প্রাকৃতিক অবক্ষয় থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে পারব। এজন্য আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে এবং একযোগে বৃক্ষরোপণ অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তবে আমরা সুন্দরভাবে বৃক্ষরোপণ করতে পারব এবং পৃথিবীটাকে আরো সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারব।