সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলন রচনা

মানুষের মনোভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হলো ভাষা। ভাষার মধ্য দিয়ে মানুষ ভাব বিনিময় করতে শেখে। মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের আত্মার সম্বন্ধ। এই মাতৃভাষার মাধ্যমে মানুষে শিশুকালে কথা বলে, বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষা -দীক্ষা, জ্ঞান অর্জন করে। আবার এর মাধ্যমে সে নিজের অর্জিত জ্ঞান, নিজের উপলব্ধি, অভিজ্ঞতাকে অন্যের কাছে ব্যক্ত করে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। জীবনের সর্বস্তরে আমরা এ ভাষা ব্যবহার করে মনের ভাব প্রকাশ করি। এ কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিল্পী, সাহিত্যিক ও মনীষীরা বাঙালি জীবনে বাংলা ভাষার চর্চা ও বিকাশের উপর গরুত্ব আরোপ করেছেন। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাঙালির ভাষার অধিকারকে কেড়ে নিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।

১৯৫২ সালে শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার পেয়েছি। বাংলা ভাষা লাভ করেছে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষ মনেপ্রাণে বিদেশি ভাষার চর্চা শুরু করেছে এবং তারা মাতৃভাষাকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছে। আধুনিক দেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে বিদেশী ভাষা শেখার প্রয়োজন আছে, কিন্তু তা মাতৃভাষা উপেক্ষা করে নয়। মাতৃভাষার চর্চা ব্যতীত উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাঙালি জাতির জন্য এর এক বিরাট গৌরব ।

আমাদের অস্তিত্ব মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আমাদের প্রথম পরিচয় হয় মায়ের সাথে। মায়ের কারণেই মানবশিশু সুন্দর পৃথিবীর মুখখানি দেখতে পায়। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর বিশাল পৃথিবীর দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের নিচে দুর্বল ও অসহায় থাকে। তখন মা-ই তাকে বুকের মধ্যে আগলে রাখেন। শিশুর জীবনের অস্তিত্ব পুরোপুরি নির্ভর করে মায়ের ওপর। আমাদের সুখ -দুঃখ, আনন্দ -বেদনা, প্রকাশের মাধ্যমে শিশু মায়ের কাছ থেকেই সর্বপ্রথম মাতৃভাষার সংস্পর্শ লাভ করে। মায়ের কাছ থেকেই আয়ত্ত করে মাতৃভাষা। ধীরে ধীরে শিশু পরিবেশের সংস্পর্শে বড় হতে থাকে। চারদিকে অনুকূল প্রকৃতি তাকে মুগ্ধ করে। মায়ের মতো সে চারপাশের প্রকৃতিকে ভালবাসতে শিখে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এইমাতৃভূমিই প্রতিটি মানুষের আশ্রয়।

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন এর ক্ষেত্রে যে অন্তরায় গুলোর কথা সাধারণত উল্লিখিত হয়ে থাকে, তার একটি হল পরিভাষার অভাব। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক বাংলা বই নেই বলে উচ্চতর শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলা প্রবর্তন প্রায় অসম্ভব মনে করেন অনেকেই। যেকোনো বিদেশী ভাষায় বিধৃত জ্ঞান শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কে তার মাতৃভাষায় অনূদিত হয়েই প্রবেশাধিকার পায়। এই প্রক্রিয়া বিড়ম্বিত হলে ভিন্ন ভাষায় রচিত যে কোন গ্রন্থ, তা যত মূল্যবান তথ্য বা তথ্য সমৃদ্ধ হোক একজন পাঠকের কাছে অর্থহীন হতে বাধ্য। অর্থ্যাৎ শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষার সাহায্য নিতে হয়। তাহলে ইংরেজি শিক্ষিত শিক্ষক কেন তার সংগৃহীত জ্ঞান ছাত্রদের কাছে সরাসরি বাংলায় প্রকাশ করতে পারবেন না?

অনেক প্রবীণ পদস্থ ব্যাক্তি মনে করেন যে, প্রশাসনিক কাজকর্মে ইংরেজিতে সে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন, বাংলায় সে সুবিধাবোধ করেন না। এটি সম্পূর্ণ মানসিকতার ব্যাপার। দৈনন্দিন জীবনে অন্যান্য পর্যায়ে বাংলা ভাষাকে যারা ভাব বিনিময়ের বাহন হিসেবে অবলীলায় ব্যবহার করেন। কেবল প্রশাসনিক নথি রচনার সময়ে বাংলা ভাষা তাদের কাছে অকিঞ্চিতকর প্রতিভাত হয় এ কারণেই যে, দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে প্রশাসন ও ইংরেজির সম্পর্ককে তারা অবিচ্ছেদ বলে জেনেছেন।

ইংরেজ অথবা পাকিস্তানি শাসকের চোখে উত্তম ইংরেজি লিখতে পারা অবশ্যই একজন বাঙালি কর্মচারীদের যোগ্যতার মাপকাঠি ধরা হতো। কিন্তু যে দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা সেখানেও ইংরেজির উৎকর্ষণ কি প্রশাসনিক দক্ষতার মূল্যায়নের প্রতিমান হিসেবে গণ্য? জনগণের ভাষা ও প্রশাসনের ভাষা আলাদা রেখে কি করে জাতীয় কর্মকান্ডের সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব?