ভাষা আন্দোলন রচনা

মাতৃভাষার অধিকার গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক অধিকার। পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ জনের মাতৃভাষা ছিল বাংলা, উর্দু কোন অঞ্চলেরই মাতৃভাষা ছিল না। অথচ উর্দু কে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়। অগণতান্ত্রিকভাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আন্দোলন শুরু হয়, তাই ভাষা আন্দোলন নামে পরিচিত। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনের উদ্যোগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

তাদের দাবি ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা। যে কারণে আমরা দেখি ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে পরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন। কিন্তু শুরু থেকেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত ছিল না।

ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্ররা বাংলা ভাষার দাবি দিবস পালন করে। ঐ দিন সাধারণ ধর্মঘট পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রধানত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের (প্রতিষ্ঠাতা ৪ঠা জানুয়ারি ১৯৪৮) নেত্রীবৃন্দ এ আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন। ১১ই মার্চ সকালে সেক্রেটারিয়েটের সম্মুখে পিকেটিংরত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদসহ অনেকে গ্রেপ্তার হন।

ভাষা আন্দোলনের এ পর্বে ১৯৪৮ সালের ২১ শে মার্চ ঢাকা প্রথম শহরে এসে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরা ওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ ঘোষণা করেন, উর্দু এবং একমাত্র উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ওই ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয়। প্রতিবাদকারীদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অন্যতম। আন্দোলনের সূচনা ও তা সংগঠিত করতে তিনি কার্যত নেতৃ স্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। যে কারণে তাকে একাধিকবার গ্রেপ্তার বরণ করতে হয়। জিন্নাহর ঢাকা সফরে আসার পূর্বে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন এর সঙ্গে ছাত্র নেতৃবৃন্দের একটি আট দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার বিষয় উদ্যােগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। ২৪ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সমবর্তন অনুষ্ঠানের জিন্নাহ ভাষা সংক্রান্ত তার পূর্ব ঘোষণা পুনরাবৃত্তি করেন। সেখানেও প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়।

বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে ছাত্রসমাজের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি সম্পূর্ণ ভঙ্গ করে ১৯৫২সালের ২৬ শে জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার নতুন ঘোষণা করেন। তার এ ঘোষণা কে কেন্দ্র করে শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত পর্ব। কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর পূর্বে আব্দুল মতিন কে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি।

খাজা নাজিমুদ্দিন কর্তৃক উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার নতুন ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদ রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে বন্দী অবস্থায় ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন, যা আন্দোলনের নতুন মাত্রা যুক্ত করে। একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে সমগ্র পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট ও বিক্ষোভ সমাবেশ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

সরকার কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারির আগের দিন ঢাকা শহরে১৪৪ ধারা জারি করে সভা- সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ছাত্ররা একুশে ফেব্রুয়ারি দিন ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে সমাবেশ অনুষ্ঠান ও মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেকে। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানের তা স্বীকৃত হয়। বাঙালিরা পৃথিবীতে একমাত্র জাতি, যারা ভাষার দাবিতে জীবন দিয়েছে।