একবিংশ শতাব্দীতে পর্যটন শিল্প একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম উপাদানের পরিণত হয়েছে। মানুষ চিরকালই সৌন্দর্যের পূজারী, কৌতূহলী এবং বৈচিত্রের প্রত্যাশী। অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার আকাঙ্খাই মানুষের মন সবসময় উন্মুখ। অজানাকে জানতে, সুন্দরকে অবলম্বন করতে আবহমান কাল থেকে মানুষ ছুটে চলেছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। মানুষের এই অদম্য উৎসাহ থেকেই পর্যটন শিল্পের জন্ম। আধুনিক বিশ্বে পর্যটন একটি বৃহৎ শিল্প হিসেবে বিবেচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্পের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমাদের দেশে পর্যটন শিল্পের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নানা কারণে এদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশের প্রত্যাশিত ও কাঙ্খিত অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে না।
অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার, অদেখাকে দেখার আকাঙ্ক্ষায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করাকে পর্যটন বলে। পর্যটন একাধারে একটি দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকান্ড। বর্তমানে পর্যটন একটি শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পর্যটন শিল্প আজ নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছে। পর্যটন শিল্পের মধ্য দিয়ে এক দেশের সাথে অন্য দেশের যোগসূত্র গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশও আজ পর্যটন শিল্প অনেক দূরে অগ্রসর হয়েছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এই দেশ। অপরিমেয় সৌন্দর্য ছড়িয়ে রয়েছে দেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে। প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, আত্মিক সকল সম্পদেই বাংলাদেশ সমৃদ্ধ। তাই যুগ যুগ ধরে বিদেশি পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশ এক স্বপ্নের দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু এবং প্রাচীন সভ্যতার একটি কেন্দ্র হওয়ার কারণে যুগ যুগ ধরে অনেক পর্যটকের আগমন ঘটেছে এ দেশে। বাংলাদেশের সুন্দরবন, সোনারগাঁও, কক্সবাজার, কাপ্তাই, কুয়াকাটা, রাঙামাটি, ময়নামতি, পাহাড়পুর, পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাস করে বিভিন্ন আদিবাসী। যেমন চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, গারো, মনিপুরী, খাসিয়া প্রকৃতি। তাদের পোশাক, জীবনযাত্রা ও ও সাংস্কৃতি পর্যটকদের এদেশের প্রতি আকর্ষণ করতে অন্যতম ভূমিকা পালন করে।
এগুলো ছাড়াও বাংলাদেশের পর্যটন স্থানের মধ্যে উল্লেখ হল ষাট গম্বুজ মসজিদ, হযরত শাহজালাল (রা.) এর মাজার, কান্তজির মন্দির, ঢাকেশ্বরী মন্দির, হোসেনের দালান, মহাস্থানগড় প্রকৃতি। এতসব সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য দেশের মতো পর্যটন বাংলাদেশে এখনো শিল্প হিসাবে পরিপূর্ণ বিকশিত হতে পারেনি।
অতিথি পরায়ণতা ও সম্প্রীতির কারণে আমাদের দেশ প্রায় সকলেরই কাছে পরিচিত। পর্যটকদের আকর্ষণ করার মত অনেক উপকরণ আমাদের দেশে থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতা পূর্বকালে এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ১লা জানুয়ারি বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন নামে একটি জাতীয় পর্যটন সংস্থা গঠিত হয়। এ দেশের পর্যটনের উন্নয়নের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সকল প্রকার কার্য পরিচালনার দায়িত্ব এই সংস্থার।
সংস্থাটি নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ এবং সেগুলো বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে। বাংলাদেশ পর্যটন সংস্থার অধীনে কক্সবাজার, রাঙামাটি, কুমিল্লা, কুয়াকাটা, রংপুর, সিলেট প্রভৃতি স্থানের ছোট বড় অফিসার শ্রেণীর হোটেল, রেস্তোরাঁ, ক্রীড়া কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। পর্যটকদের সুবিধার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস সহ নানা ধরনের যানবাহনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে নিরাপত্তার জন্য পুলিশের ব্যবস্থা আছে। রাঙ্গামাটি ও কাপ্তাই এর হাউসবোট ও স্পিডবোটের ব্যবস্থা রয়েছে। পর্যটকদের সুবিধার জন্য পর্যটন সংস্থা টুরিস্ট গাইডের ব্যবস্থা করেছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গার পর্যটনের উৎকর্ষ সাধনের পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে, রয়েছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। এদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া, নৈসর্গিক দৃশ্য সবই পর্যটন শিল্পের অনুকূলে। এখন শুধু প্রয়োজন সুষ্ঠু বিনিয়োগ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ। পাশাপাশি বাংলাদেশের দৃশ্যগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের সামনে তুলে ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প কর্মসংস্থান বিনিয়োগ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস হতে পারবে। আর এভাবে পর্যটন শিল্পের উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারবে এবং বাংলাদেশের অবকাঠামগত উন্নয়নও সম্ভব হবে। তাই বাংলাদেশ সরকারের উচিত পর্যটন শিল্পের দিকে মনোযোগ দেওয়া এবং এই শিল্পের উন্নয়নের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া।