বাংলাদেশের উৎসব রচনা

“মানুষেরা উৎসব করে। মানুষ যেদিন আপনার মনুষত্বের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি করে, সেই দিন। প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।”_ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ঋতুর বর্ণময় আত্মপ্রকাশের রঙ্গমঞ্চে বাঙালির ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অনেক উৎসব আসে। উৎসব জীবনের ছন্দ স্পন্দন, প্রতিদিনের তুচ্ছতার যবনিকা, আত্মার দিগন্ত প্রসারণের চলন্তিকা। ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর রূপ-বৈচিত্র্যের বাংলাদেশ যেমন সৌন্দর্যময় তেমনি ভিন্ন ভিন্ন উৎসবে এ দেশ আনন্দময়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উৎসবে মেতে উঠে এদেশের মানুষ। তাই এ দেশকে বলা যায় উৎসবের দেশ। উৎসব যে কেবল মানব মনে আনন্দ সঞ্চার করে তাই নয়, বিভিন্ন উৎসবের মধ্য দিয়ে কোন দেশের সামগ্রিক চিত্রটি প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।

আমাদের দেশে পালিত বিভিন্ন উৎসব আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। উৎসবের মধ্য দিয়ে মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে মিলনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে উত্তীর্ণ হয়। প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততা মানুষের জীবনকে গড়ে তোলে ক্লান্ত- শ্রান্ত, বৈচিত্রহীন। এই কর্মব্যস্ত জীবনে মানুষ একটু আনন্দ, একটু স্বস্তি চাই। বিভিন্ন উৎসব জীবনে এই আনন্দের বাণী নিয়ে আসে। প্রায় প্রতি মাসেই বাংলাদেশে কোনো না কোনো উৎসব পালিত হয়। এদেশের উৎসব গুলো কখনো কখনো দেশের সীমানা ছাড়িয়ে প্রভাব ফেলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।

উৎসব বলতে মূলত আনন্দময় অনুষ্ঠানকে বোঝায়। উৎসবের মাধ্যমে আমরা আনন্দ প্রকাশ এবং আনন্দ লাভ করে থাকি। তবে এ আনন্দ একার আনন্দ নয়। পারিবারিক, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক পরিমন্ডলের সকলের সম্মিলনে সুখ ও আনন্দ লাভের উপায় হলো উৎসব। সে অর্থে উৎসব সকলকে আনন্দ দেয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের উৎসবের প্রচলন রয়েছে। এ উৎসবগুলো বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলাদেশের উৎসবগুলোকে প্রধানত কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যেমন: ধর্মীয়, সামাজিক, জাতীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব।

সাধারণত ধর্মীয় উৎসবগুলো এক একটি ধর্ম বিশ্বাস ও ভাবনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের ধর্মীয় উৎসব গুলোর মধ্যে রয়েছে মুসলমানদের ঈদ-উল-ফিতর, ঈদু-উল- আযহা, ঈদ- ই- মিলাদুন্নবী, মহরম। হিন্দুদের দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতী পূজা। বৌদ্ধদের বুদ্ধ পূর্ণিমা। খ্রিস্টানদের বড়দিন প্রভৃতি প্রধান ধর্মীয় উৎসব। বাংলাদেশ উৎসবের দেশ। এ দেশের নানা ধরনের সামাজিক উৎসব রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বাংলা নববর্ষ, হালখাতা, বিবাহ, ভাইফোঁটা, অন্নপ্রাশন, খতনা, জন্মদিন, নবান্ন, শ্রাদ্ধ, পৌষ পার্বণ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

উৎসব কেবল লোকাচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের দেশে এমন কিছু উৎসব রয়েছে যেগুলো কোন ধর্ম কেন্দ্রিক সম্প্রদায়, পরিবার প্রভৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এগুলো সকল ধর্মের, সকল শ্রেণীর মানুষের উৎসব। এর সর্বজনীন উৎসবগুলো আমাদের কাছে জাতীয় উৎসব হিসেবে পরিচিত। যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি বা শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বুদ্ধিজীবী দিবস প্রভৃতি। এ উৎসবগুলো যেমন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালন করা হয় তেমনি সামাজিকভাবেও আমরা এগুলো পালন করি। বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনেক দিনের পুরনো। তবে এর আধুনিকায়ন ও ঘটেছে। আধুনিক কালে এর পরিসর ও আরো অনেক বেড়েছে। যাত্রা, খেলাধুলা, নাটক, সার্কাস, মেলা, বর্ষবরণ, সংগীতানুষ্ঠান, বইমেলা, রবীন্দ্র -জয়ন্তী, নজরুল -জয়ন্তী প্রভৃতি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক উৎসব।

মানুষের বেদনা বিধুর, কর্মব্যস্ত, একঘেয়ে জীবনে উৎসব আনন্দের সঞ্চার করে। অবসাদ ও গ্লানি দূর করে আমাদের এক নতুন জীবন দান করে। তাই মানুষের জীবনে উৎসবের প্রয়োজন আছে। তবে মনে রাখতে হবে উৎসব মানে কেবল উল্লাস নয়, আনন্দ মানে নয় যথেচ্ছাচার। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের দেশে অনেকেই উৎসবের নামে করেছে যথেচ্ছাচার। যেমন, থার্টি ফাস্ট নাইট ইত্যাদি। এজন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ফলে আমাদের অনেক উৎসবইএখন হুমকির সম্মুখীন। আমাদের উৎসবের যে মহান মূল্যবোধ আমাদের চলতে সাহায্য করেছে, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তুলেছে তাকে আবার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।