বাংলাদেশর ষড়ঋতু রচনা

রুপসী বাংলার রূপের শেষ নেই। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বঙ্গ জননীও তার বেশ পরিবর্তন করে। একই অঙ্গে এত রূপ পৃথিবীর আর কোন দেশে না থাকলেও আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ আছে। তাই সে রূপ- বৈচিত্রে অনন্য । হাটি হাটি পা পা করে ষড়ঋতু পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের চালায় তাদের সফরসূচি। এ ষড়ঋতুর আগমনে সত্যিই বাংলাদেশ ধারণ করে এক বিচিত্র রূপ। কখনো সে সন্ন্যাসী, কখনো সে ক্রন্দন শিলা রমণী, কখনো সে হাস্যমুখরা আনন্দিতা আবার কখনো সে ছন্দময়ী। তাইতো বাংলাদেশ রুপে রহস্যময়ী।

বৈশাখ এবং জ্যৈষ্ঠ এ দুমাস গ্রীষ্মকাল। অগ্রিমশাল হতে ধারণ করে মাঠ-ঘাট পোড়াতে পোড়াতে গ্রীষ্মরাজের আগমন। প্রকৃতি যেন তখন ভয়ঙ্কর এক ঋষি। এই বুঝি সে সব জ্বালিয়ে পুরিয়ে ছারখার করে দেবে। ধুলোয় ধূসরিত হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। হঠাৎ ইশান কোণে দেখা যায় পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। তারপরই শুরু হয় কালবৈশাখীর তাণ্ডব নৃত্য। এ সময় বাংলাদেশের গ্রামগুলো যেন মরুর বুকে মরুদ্দ্যান। কারণ, তখন ঘরে ঘরে আম, কাঁঠাল, জাম, জামরুল, তরমুজ, নারিকেলের মত অমৃত রসায়ন মানুষের শ্রান্তি -ক্লান্তি দূর করে।

শীতের জড়সড় ভাব কে কাটিয়ে গ্রীষ্ম আমাদের দ্বারে এসে হাজির হয়‌‌। এর আয়ুষ্কাল দুই অথবা তিন মাস। এ সময় প্রকৃতি অভিনব রূপ ধারণ করে। সূর্য আকাশ থেকে অগ্নি বর্ষণ করে। নদীর পানি কমে যায়। মাঠঘাট ফেটে চৌচির হয়। উত্তপ্ত হওয়ায় ঝাপটা লাগে চোখে- মুখে। গ্রীষ্মের ওই সকল কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয় এ ঋতুটা যেন একটি কাঠিন্যের প্রতিক। ভয়াবহ রূপ নিয়ে হাজির হয় গ্রীষ্ম। এর কাছে সুন্দরের কোন আদর নেই। গ্রীষ্মের সময় দেখা দেয় গ্রামের আনাচে-কানাচে কলেরা- বসন্ত মহামারী রূপে এবং এর করাল গ্রাসে কত শত নর-নারী পতিত হয় তার হিসেব দেওয়া কঠিন।

গ্রীষ্ম বিদায় নেয়, দ্বিগ্বিজয়ী যোদ্ধার বেশে হয় বর্ষার আবির্ভাব। বিজলির রসনাই তার নিশান, মেঘের গর্জন তার তূর্যোধনি। মেঘের গুরু গর্জনে প্রকৃতি থেমে থেমে শিহরিয়া ওঠে। গ্রীষ্মের নিষ্প্রভ প্রকৃতিকে পূর্ণ করে তোলে। গ্রীষ্মের নিদারুন রোদে যে প্রকৃতি রিক্ত হয়ে গিয়েছিল, সে প্রকৃতির বর্ষার অমীয় ধারায় প্রাণ বন্যায় মেতে উঠে। এ বর্ষায় বাংলাদেশের ভরসা। শরতের আগমন ভাদ্রে ,আশ্বিনে তার দানপর্ব আর কার্তিকে তার প্রস্থান। এ সময় আমন চারাগুলো বড় হয়ে ওঠে। ঝিলে- বিলে শাপলা শালুক আর পদ্ম ফুলের জলসার আসর বসে। শরৎরানীর রূপের পরশে শিউলি বকুল ফুটে ওঠে। জোসনায় যাগে স্বপ্নের শিহরণ।

ধীরে ধীরে বিদায় নেয় শরৎ আসে হেমন্ত। হিমেল ওড়নায় মুখ ঢেকে হেমন্ত এসে কৃষকের ফসল কাটার গান শোনায়। সে সকলের ফসল তুলে দেয়। কৃষকের ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব আরম্ভ করে দিয়ে শীতের কুজ্ঝটিকার আড়ালে হেমন্ত একসময় বিদায় নেই। কুয়াশার মলিন চাদরে মুখ ঢেকে হেমন্তের শেষে শীতে এসে প্রবেশ করে। সমস্ত প্রকৃতিকে শীত তখন নিবারণ করে দেয়। হিমেল হাওয়া আর কুয়াশায় শীতের বিশ্বস্ত অনুচর। তবুও তার হাতে সবুজ তরিতরকারি ও খাদ্য শস্য বিলাতে আরম্ভ করে। পৌষের পিঠা আর খেজুর রস দিতে শীত কার্পণ্য করে না। ঘাসের মাথায় শিশুর বিন্দু আমাদের ভালো লাগে। রোদ পরে শিশির বিন্দুগুলো হীরকের মত জ্বলে। বাগানের গোলাপ শীতের কুয়াশাতে ও গন্ধ ছড়ায়। মাঘের শেষে মনে হয় বসন্ত আসছে । দেখতে দেখতে শীতের দিন চলে যায়। বাংলার প্রকৃতিতে ফাল্গুন আসে।

শীতের শেষে আসে বসন্ত। এবার প্রকৃতিতে উঠে নবযৌবনা। শাখায় শাখায় কিশলয় যৌবনের সঞ্জীবনী রসে পুষ্ট হয়ে ওঠে। শাখায় শাখায় ফোটে ফুল। ঘুম ভেঙ্গে যায় গোলাপ, বেলি, চম্পা ও পারুলের। গুন গুন রবে মৌমাছি ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে। কোকিল কুহু কুহু মুহুর মুহু ডেকে চলে। বসন্তের ঐশ্বর্যের শেষ নেই। সে কিছুই নিতে আসে না, আসে শুধু দিতে। তাই তো সে ঋতুরাজ। অনন্ত রূপের খনি বাংলাদেশ। এখানে চলে ঋতুনাট্যের নাট্যাভিনয়। অপূর্ব সুন্দরী আমাদের ঐশ্বর্যময়ী জন্মভূমি।