বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা রচনা

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতার নাম সায়েরা খাতুন। বাল্যকালে তিনি ছিলেন প্রতিবাদী, সাহসী ও কর্মচঞ্চল। তিনি দুচোখ ভরে বাংলার প্রকৃতিকে দেখতেন। অনেক সময় তিনি নীল আকাশে উড়ে যাওয়া মুক্ত পাখির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। চাষীদের কঠোর পরিশ্রম মজুরের কষ্ট থেকে তিনি হৃদয়ের ভিতর গভীরে এক কম্পন অনুভব করতেন। তাই তিনি সুখী ও সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট কতিপয় সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশ তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে।

পাকিস্তান সৃষ্টির কিছুদিন পরেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আসলে আমরা স্বাধীন নয়। ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তখন শেখ মুজিবরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে শুরু হয় পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুকে এক সময় কারারুদ্ধ করা হয়। ১৯৫৩ সালে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন এবং শেরেবাংলার সাথে মিলিত হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন।

১৯৫৪ সালে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগ পরাজিত হয়। শেখ মুজিব যুক্তফ্রন্ট সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন। কিন্তু পাকিস্তান শাসক চক্র এ সরকার ভেঙে দেয়। বাঙ্গালীদের উপর নেমে আসে অত্যাচারের স্টিমরোলার। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারি হলে বাঙালিরা অধিকার হারা হয়ে পড়ে। শেখ মুজিব সেই হারানো অধিকার কে ফিরিয়ে আনার জন্য শুরু করেন সংগ্রাম। পাকিস্তানের দুটি অংশের বৈষম্য এমনই প্রকোট রুপ ধারণ করল যে, উচ্চ পদে চাকরির ক্ষেত্রে আমরা 15% এর বেশি নিয়োগ পেতাম না। জাতীয় আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। এসবের প্রতিবাদের শেখ মুজিব দুর্বার গণ আন্দোলন গড়ে তোলেন।

১৯৬৬ সালে জননেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য মুক্তি সনদ ৬ দফা দাবি পেশ করেন। আইয়ুব সরকার শেখ মুজিবকে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করলেন। অত্যাচার আর শোষণের মাত্রা বেড়ে গেল কয়েকগুণ। শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। সারা দেশে মুজিবের মুক্তির জন্য গণ আন্দোলন শুরু হয়। ৬৯- এ সেই গণ আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিল। আগরতলা মামলা তুলে নিতে বাধ্য হলেন আইয়ুব সরকার। সারা দেশে প্রবল আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খান এর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবের আওয়ামীলীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করল। কিন্তু পাকিস্তানি ক্ষমতালোভের সরকার বাঙ্গালীদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি হলো না। শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে দীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।

এ সংগ্রাম যখন চরম রূপ ধারণ করে তখন বর্বর ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২ টা থেকে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করে। ওই রাতে বঙ্গবন্ধু বন্দী হন। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের কারাগারে আটকে রাখা হয়। এরপর আরম্ভ হয় দুর্বার প্রতিরোধ সংগ্রাম। গ্রামে- গঞ্জে গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় এ দেশের আপামর জনগণ কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক এবং সকল পেশাজীবী। দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ চলে। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।