পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে একটা নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে মানুষ যেমন একটু একটু করে তার পরিবেশে গড়ে তুলেছে, তেমনি সভ্যতার চরম লগ্নে এসেছে মানুষই আবার তার পরিবেশকে নানা উপায়ে ধ্বংস করে চলছে। তাই তো মানব সভ্যতা আজ হুমকির সম্মুখীন। আদিম যুগের পৃথিবীতে যখন থেকে আগুনের ব্যবহার শুরু হয়, তখন থেকে প্রাণ প্রদায়ী অক্সিজেনের ধ্বংস শুরু হয়। আর এই অক্সিজেনের ধ্বংসের সাথে সাথে কেবল পরিবেশের ভারসাম নষ্ট হলো না। বরং ধোয়া এবং ভস্ম কণায় পরিবেশ করে তুলল কলুষিত।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির অপরিকল্পিত গতি পরিবেশ দূষণের প্রধান কারণ। জনসংখ্যার বর্ধিত চাপে বিভিন্নভাবে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। শিক্ষা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া জনজীবনকে দূর্বল করে তুলছে। সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা জনসংখ্যার বর্ধমান চাপে গোটা দেশের সামগ্রিক পরিবেশ দ্রুত বিপন্ন হচ্ছে। পরিবেশ দূষণ, পানি দূষণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া মারাত্মক আকার ধারণ করছে। আমাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর দূষিত বস্ত্র প্রতিনিয়ত নর্দমা ও ড্রেনের মাধ্যমে নদীতে গিয়ে পড়ছে। এর ফলে শুধু মানুষই নয়, বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও মাছ আক্রান্ত হচ্ছে। যান্ত্রিক সভ্যতার সুবাদে শব্দের ব্যবহার অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু শব্দের গতি যদি অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়, তখন তাকে শব্দ দূষণ বলে। যেমন গাড়ির হর্ন, কলকারখানার বিকট আওয়াজ, উৎসব মুখরতা ও মাইকের আওয়াজ শব্দ দূষণের বিভিন্ন উপকরণ।
ফসলের ফলন বৃদ্ধি এবং কীট পতঙ্গের হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য পরিকল্পনা বিহীন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। তেজস্ক্রিয় পদার্থের দহনে পরিবেশ মারাত্মক দূষণের সম্মুখীন হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পরীক্ষামূলক পদ্ধতির পরিবেশের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে। পারমাণবিক কেন্দ্রের দুর্ঘটনা ও মহাকাশ অভিযান এবং উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিষাক্ত গ্যাস থেকে বিভিন্ন রোগের উদ্ভব এবং সার্বিকভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
বসতবাড়ি নির্মাণ এবং জ্বালানি চাহিদা পূরণের জন্য নির্মমভাবে বৃক্ষ নিধন পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। বাঁচার জন্য মানুষ প্রকৃতি আর পরিবেশকে প্রতিকূল করে তুলছে।। যুদ্ধ-বিগ্রহ পরিবেশকে দূষিত করে। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার মানব জীবনে ও পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের উপর নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমার ক্ষতিসাধন আজও দুঃস্বপ্ন হয়ে আছে।
পরিবেশ দূষণের প্রতিক্রিয়া সারা পৃথিবীতে শুরু হয় বিশ শতকের চতুর্থ দশকে। ১৯৩২ সালে বৃটেনের মস্ত নিকেল কারখানায়, ১৯৩৭ সালে ওয়েলস নিকেল কারখানায় কর্মীদের ক্যান্সার দেখা দেয়। ১৯৫৩ ও ১৯৬৫ সালে জাপানের সিনাসাটী ও সিগাটা উপসাগরে মাছে মাধ্যমে স্নায়ুবিক রোগ ও মৃত্যু ঘটায়। ১৯৫২ সালে লন্ডনে প্রচুর লোক ধোঁয়াজাত রোগে আক্রান্ত হয়। ১৯৭২ সালে স্টোকহোমে পরিবেশকে দূষণমুক্ত করকর আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের তীরবর্তী দেশগুলো দূষিত পদার্থ সুমুদ্রে না ফেলার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিওডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত হয়েছে বার দিনব্যাপী ধরিত্রী সম্মেলন। এ সম্মেলনে শতাধিক রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন।
পরিবেশ দূষণে বিশ্বের সকল সচেতন নাগরিক আজ আতঙ্কিত। এ ভয়ংকর সমস্যার মোকাবেলার কথা ভাবছে সবাই। বায়ূ দূষণের প্রতিকার করা হচ্ছে। গ্যাসে অতিরিক্ত কোন পদার্থ মিশিয়ে দিয়ে দূষক অপসারিত হতে পারে। বৃক্ষরোপন, ক্ষতিকারক পতঙ্গের জীবনচক্র নিরোধ, রাসায়নিক পদার্থের শোধন, ধোঁয়ার পরিশ্রুতিকরণ, বসতি ও শিল্প এলাকার মধ্যে দুরুত্ব তৈরি, শব্দের নিয়ন্ত্রণ ও মানব চেতনার উদ্বোধন কাম্য হয় শব্দ দূষণ প্রতিকারের জন্য। আজ পরিবেশ দূষণ মানব সভ্যতার এক ভয়ংকর বিপদ। পৃথিবী নামক গ্রহটিকে প্রাণী জীবনের উপযোগী করে তোলায় হবে আমাদের প্রথম কাজ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তুলতে আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাতে পারি। তাহলেই আমরা পরিবেশ দূষণ রোধ করতে পারবো।