আধুনিক সভ্যতা মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ও সাধনার ক্রমপরিণতি। মানুষ তার যুগ যুগান্তরের স্বপ্ন ও সাধনার ফসল দিয়ে নির্মাণ করেছে এ সভ্যতা। এ সভ্যতার মত বিজ্ঞানও মানুষের কঠোর সাধনার ফসল। প্রাচীন যুগের আগুন আবিষ্কার থেকে শুরু করে বর্তমান যুগের বিস্ময়কর আবিষ্কার কম্পিউটার সবই বিজ্ঞানের কল্যাণের সম্ভব হয়েছে। বিজ্ঞান আমাদের জীবনযাত্রায় এনেছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। আমাদের প্রতিটি কাজের চালিকাশক্তি হলো এই বিজ্ঞান। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে সারা বিশ্বে বিজ্ঞানের অভাবনীয় বিস্তৃতি ঘটে। সেই সময়ই মানুষ প্রথম বাষ্প শক্তিকে কাজে ব্যবহার করতে শিখে। ক্রমে ক্রমে আসে বিদ্যুৎ শক্তি, পেট্রোলিয়াম, পারমাণবিক শক্তি, প্রাকৃতিক শক্তি প্রভৃতি বিজ্ঞানের সব আবিষ্কার আমাদের জীবনযাত্রায় এনে দিয়েছে গতি, দিয়েছে শক্তি। তাই বিজ্ঞান ছাড়া আধুনিক জীবনের কথা ভাবায় যায় না।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব অনস্বীকার্য। পথে- ঘাটে, অফিস- আদালতে, অনুষ্ঠানে, সংবাদ -সংলাপের, সর্বত্র বিজ্ঞান পরিব্যাপ্ত। দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের অবদান মানুষকে দিয়েছে অপরিমিত সুখ ও স্বাচ্ছন্দ। টুথপেস্ট, ব্রাশ, স্টোভ, হিটার, বৈদ্যুতিক পাখা, কম্পিউটার, তেল, সাবান, পাউডার, পারফিউম, আয়না, চিরুনি, ইস্ত্রি প্রভৃতি ছাড়া দৈনন্দিন জীবনের কথা চিন্তাই করা যায় না। মোট কথা বিজ্ঞান কে মানুষ নানাভাবে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করছে।
সভ্যতার সূচনা লগ্ন বৈজ্ঞান শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ কৃষির উদ্ভাবন করে। কৃষি বিজ্ঞানীরা বর্তমান শতাব্দীতে কৃষি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ব্যবহারকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছেন। অল্প জমিতে অধিক ফসল উৎপাদনের প্রয়াসে যান্ত্রিক সরঞ্জামের আবিষ্কার কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লবের সূচনা করেছে। ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার এর সাথে আরো নানা ধরনের যান্ত্রিক সরঞ্জামের আবিষ্কার মানুষকে শ্রমের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছে। পাম্প, গভীর নলকূপের মাধ্যমে তারা এখন সহজে জমিতে ছেচ দিতে পারছে। একই সঙ্গে গোবর সার, কম্পোস্ট সার ও সবুজ সারের স্থলে রাসায়নিক সার আবিষ্কারের ফলে উৎপাদন বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ধান ও গমের ক্ষেত্রে উচ্চফলনশীল বীজ উদ্ভাবিত হয়েছে। অনেক সবজি ও ফলেরও উন্নত জাত উদ্ভাবনের ফলে কৃষি ক্ষেত্রে সম্ভাবনা দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে।
বিজ্ঞানের কল্যাণে পথের দূরত্ব মানুষের কাছে এখন আর কোন কঠিন বিষয় নয়। দ্রুতগামী যানবাহন আবিষ্কারের ফলে আমরা সহজে পৌঁছাতে পারছি আমাদের গন্তব্যে। উড়োজাহাজ আবিষ্কারের মাধ্যমে এক দেশের সাথে অন্য দেশের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। মোবাইল, টেলিফোন, ফ্যাক্স, রেডিও, ইমেল ইত্যাদির মাধ্যমে এক মুহূর্তে বিশ্বের যে কোন খবর আমাদের কাছে পৌঁছে যায়। শুধু তাই নয় রকেটে করে মানুষ এখন মহাকাশে ভ্রমণ করছে। পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে স্থাপন করা হয়েছে কৃত্রিম উপগ্রহ। আন্তর্জাতিক টেলি কমিউনিকেশন নামক এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্যাটেলাইট ব্যবহার করে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করা যায়। ফাইবার অপটিক্স এর মাধ্যমে মোবাইলে কথা বলার পাশাপাশি পরস্পরের ছবিও দেখা যাচ্ছে। কম্পিউটারের বিভিন্ন তথ্যাবলি আদান প্রদান করা যাচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে।
প্রাত্যহিক জীবনে অতিমাত্রায় যন্ত্র নির্ভরতার কুফল ও কম নয়। বিজ্ঞান মানুষের প্রাণ চাঞ্চল্যকে হরণ করেছে, তার সহজ ও স্বাভাবিক অনায়াস জীবনচর্চা কে করেছে ব্যাহত। তার শরীর ও মন যেন প্রকৃতির আনন্দময় সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যন্ত্রকে মানুষ যতই প্রশ্রয় দিচ্ছে ততই তার জীবনে কৃত্রিমতা, অবসাদ বাড়ছে। গত শতাব্দীতে সংঘটিত বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা এখনো মানুষকে আতঙ্কিত করে রেখেছে। বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে মানুষ তৈরি করেছে আণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা এবং অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র।
আধুনিক মানুষ জীবনে চলার প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক সুযোগ-সুবিধা কে ব্যবহার করছে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে বিজ্ঞান ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিজ্ঞান কেবল মানুষকে সুখ স্বাচ্ছন্দই দিচ্ছে না, জীবনের প্রতি মুহূর্তে বিজ্ঞানের প্রয়োগ তার মন কে করেছে পরিশীলিত। কিন্তু আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে যে, বিজ্ঞানের অকল্যাণকর কিছু দিক আছে। সে দিকগুলো অবশ্যই আমরা বর্জন করব।