একুশের চেতনা ও সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলন রচনা

মানুষ ভাবের বিনিময় করে ভাষার মাধ্যমে। এ ভাষার গুনে পৃথিবীর সকল প্রাণী থেকে মানুষ স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী। মানুষ তার হাসি, আনন্দ, দুঃখ, বেদনা সবকিছুই প্রকাশ করে ভাষার মাধ্যমে। মাতৃভাষা ছাড়া তৃপ্তি মিটিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করা যায় না। মাতৃভাষার এই গুরুত্বের কথা ভেবে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছে মাতৃভাষার মাধ্যমে। মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে শিশুর মনে স্বদেশ প্রেমের সূত্রপাত ঘটে।আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বিদেশি শাসকরা এ ভাষাকে যুগে যুগে প্রদানত করতে চেয়েছে। তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এদেশের মানুষ। করেছে ভাষা আন্দোলন। অনেক রক্ত ঝরেছে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে অকাতরে জীবন দিয়ে তার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা ভাষার মর্যাদা। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত।

১৯৯৯ সালের ১৭ ই নভেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাঙালি জাতির জন্য এ এক বিরাট গৌরব। এদিকে সারা বিশ্বের মানুষ জানতে পারবে বাংলাদেশ নামে একটি দেশের কথা। বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষার কথা। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশের ভাষাগুলো মর্যাদা লাভের পথ খুঁজে পাবে। বলা যায় ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এক বিরাট ভূমিকা পালন করবে।

মাতৃভাষা প্রতিটি জাতির মূল্যবান সম্পদ। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইংরেজির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও মাতৃভাষা ছাড়া পরিপূর্ণভাবে মনোভাব প্রকাশ করা যায় না। তাই স্থানীয় পর্যায়ে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। যে ভাষা জনসাধারণের বোধগম্য নয় সে ভাষায় অন্যের সঙ্গে প্রাণ খুলে ভাব বিনিময় করা যায় না। সেসব লোকের পক্ষে মাতৃভাষায় কথা বলা বা লেখায় একমাত্র পন্থা। বিশিষ্ট ভাষা বিজ্ঞানী ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ভাষায় বলা যায়, “আমরা বঙ্গ দেশবাসী। আমাদের কথাবার্তা, ভয়-ভালোবাসা চিন্তা- কল্পনার ভাষা বাংলা। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা।”

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের ক্ষেত্রে যে অন্তরায় গুলোর কথা সাধারণত উল্লেখিত হয়ে থাকে, তার একটি হলো পরিভাষার অভাব। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক বাংলা বই নেয় বলে উচ্চতর শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলা প্রবর্তন প্রায় অসম্ভব মনে করে অনেকেই। যে কোন বিদেশী ভাষায় অর্জিত জ্ঞান শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কে তার মাতৃভাষার অনূদিত হয়েই প্রবেশাধিকার পায়। এই প্রক্রিয়া বিলম্বিত হলে বিভিন্ন ভাষায় রচিত যে কোন গ্রন্থ, তা যতো মূল্যবান তথ্য বা তথ্যসমিদ্ধ হোক, একজন পাঠকের কাছে অর্থহীন হতে বাধ্য। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীকে মাতৃভাষার সাহায্য নিতেই হয়। তাহলে ইংরেজি শিক্ষিত শিক্ষক কেন তার সংগৃহীত জ্ঞান ছাত্রদের কাছে সরাসরি বাংলায় প্রকাশ করতে পারবেন না?

অনেক প্রবীণ পদস্থ ব্যাক্তি মনে করেন যে প্রশাসনিক কাজকর্মে ইংরেজিতে স্বাচ্ছন্দ অনুভব করেন। বাংলায় সে সুবিধা বোধ করেন না। এটি সম্পূর্ণ মানসিকতার ব্যাপার। দৈনন্দিন জীবনে অন্যান্য পর্যায়ে বাংলা ভাষাকে যারা ভাব বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে অবলীলায় ব্যবহার করেন, কেবল প্রশাসনিক নথি রচনার সময়ে বাংলা ভাষায় তাদের কাছে প্রতিভাত হয় না। এ কারণে যে দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে প্রশাসন ও ইংরেজি সম্পর্ককে তারা অবিচ্ছেদ বলে জেনেছেন। ইংরেজি লিখতে পারা অবশ্যই একজন বাঙালি কর্মচারীর যোগ্যতার মাপকাঠি ধরা হতো। কিন্তু প্রশাসনিক দক্ষতার ভাষা ও প্রশাসনের ভাষা আলাদা রেখেই কি করে জাতীয় কর্মকাণ্ডে সাধারন মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব?

মাতৃভাষা ছাড়া মন উজাড় করে ভাব প্রকাশ করা যায় না। তাই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। নিরর্থক ইংরেজি প্রবণতা এবং মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা হীনমন্যতার পরিচয় ছাড়া আর কিছু নয়। যে জাতির ভাষা যত সমৃদ্ধ, সে জাতি তত উন্নত। একথা স্মরণ রেখে মাতৃভাষার উন্নয়ন এবং তাকে সর্বোচ্চ স্তরে ব্যবহারের প্রচলনের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠা চালিয়ে যেতে হবে। এর জন্য সরকারি ভাবে কঠোর আইন জারি করতে হবে। তাহলে সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলন গুরুত্ব লাভ করবে।