হেমন্তর অবসানে হিম শীতল বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে শীত এসে হাজির হয়। এ যেন হেমন্তের প্রগাঢ়তম রুপ। হেমন্তের ত্যাগের ব্রত শীতে পরিপূর্ণতা লাভ করে। কুজ্ঝটিকার ধূসর পর্দায় নিজেকে আড়াল করে প্রকৃতি তখন এক এক করে তার সমস্ত আবরণ খুলে ফেলতে ফেলতে দীন-হীন বেশ ধারণ করে। ধরিত্রী যেন রোগ শয্যায় শুয়ে কাঁপতে থাকে। তার শীতল নিঃশ্বাসে আবহাওয়া শীতল হয়ে যায়। সূর্য যেন সুদূর মকর ক্রান্তি থেকে তাপ বিকিরণ করতে থাকে। দিন ছোট হয়, রাত বড় হয়।
সবখানে যেন একটা মলিন ভাব বিরাজ করে। শীতের সকাল সত্যিই ভয়াবহ। কুজ্ঝটিকার পর্দায় পৃথিবীর মুখ তখন থেকে যায়। সম্মুখে দৃষ্টিপাত করে কিছুই দেখা যায় না। প্রকৃতি তার জীর্ণরূপ দেখে বুঝি রাত্রিতে অশ্রুপাত করে, সেই অশ্রুতে মাঠের ঘাস ও বনানীর বৃক্ষলতা ভিজে যায়। ঘরের জানালা খুলে বসার উপায় নেই। বিন্দু বিন্দু ঠান্ডা কুয়াশা ও শীতল বাতাস ঘরে ঢুকে যেন আঘাত করতে থাকে।
সূর্যের কুজ্ঝটিকায় যবনিকার আড়ালে ঢাকা পড়ে। বহু কষ্টে দিনের আলোকে পৃথিবীতে পৌঁছে দিলেও তার রশিকে সে প্রকাশ করতে পারেনা। কৃষকেরা শীতে সংকুচিত পশুদের নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে কোনমতে পথ চলতে থাকে। গ্রামের দরিদ্র লোকেরা তাদের সন্তানদের জামা কাপড় দিতে পারে না। তাই তারা ফেলে দেওয়া খরকুটো জোগাড় করে তাতে অগ্নিসংযোগ করে নিজেদের দেহ গরম করতে লেগে যায়। অনেক সময় বৃদ্ধিরাও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। শীতের সকালের স্ফুর্তিতে এক ভিন্ন রূপের ঐশ্বর্য দেখা যায়। খুব ভোর থেকে আকাশ- বাতাস, মাঠ -প্রান্তর কুয়াশায় সাদা চাদরে ঢাকা থাকে হালকা-পাতলা ধোঁয়ার মতো কুয়াশার আস্তর দিয়ে ঘরবাড়ি, জীবজন্তু, মানুষ সবই আচ্ছন্ন করে রাখে।
সূর্য লাল হয়ে উকি দেয় পুব আকাশে । তার আগে অনেকক্ষণ ধরে সূর্য ওঠার প্রস্তুতি চলে। রোদের তাতে একটু একটু করে কুয়াশার জাল ছেড়ে যাই। গাছপালা ,মাঠ -ঘাট ,নদী ,বিল, বাড়িঘর, মানুষ ,জীবজন্তু স্পষ্ট হয় ।পরস্পরের কাছে ঝকঝকে রোদ হাসতে থাকে। শীতের সকালে দুনিয়াতে নতুন করে জীবনের সাড়া জাগে ।পথে ঘাটে ছেলে- মেয়ে ,লোকজন গাড়ি-ঘোড়ার আনাগোনা শুরু হয় ।শীতের সকালে গ্রাম বাংলার রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাড়ির উঠানের ধারে আগুন জেলে ছেলে ,বুড়ো সবাই জড়ো হয়ে শরীরটা চাঙ্গা করে নেয়। চলে দলবদ্ধ হয়ে নানা গাল গল্প, হাসি -ঠাট্টা আরও কাজের কথা।
খেজুর রস গরম করে আর সকালে পাটালি গুড় সহযোগে চিরে- মুড়ি-খই খায় গ্রাম বাংলার ছেলে মেয়েরা । যার যা সম্বল গায়ে দিয়ে বের হয় রাস্তায় ।পুকুর ধারে, নদীর পাড়ে, মাঠে-প্রান্তরে চিক চিক করে । শিশির স্নাত ঘাস ,লতাপাতা, গাছ-গাছালের আগাগুলো রূপালী ছবির রূপ দেখে মন হয় আনন্দিত ।ছেলেমেয়েদের বার্ষিক পরীক্ষা প্রায় শেষ হয় তখন। তাই শীতের সকালটা অনেকক্ষণ ধরে রোদ লাগিয়ে খেলা খেলে হৈচৈ করে কাটে তাদের। কষ্ট হয় সাত সকালে উঠলে ।তাই অনেকখানি রোদ ঝলমল সকাল না হওয়া পর্যন্ত তারা বড় একটা বাইরে আসে না।
গ্রাম বাংলার বড় প্রিয়খন এ শীতের সকাল ।খাওয়া-দাওয়া ,খেলা- ধুলা ,মাছ ধরা, শস্য ফলানো এসবই শীতের সকালে মুগ্ধ করে বাংলার মানুষকে ।কিন্তু গরিব যারা জামা কাপড় জোটে না, যাদের লেপ-কাথার অভাব যাদের, শীতের সকাল তাদের কাছে সর্বনাশ ডেকে আনে ।কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ এই উক্তি কত যে সত্য তা শীতের অভাবগ্রস্থ মানুষকে দেখলে অনুভব করা যায় । তবু শীতের সকাল আমাদের জীবনকে সকালের বার্তা বয়ে আনে। শীতের সকাল আমার খুব ভালো লাগে।
শীতের সকাল এমন একটি সময় যখন জীবনের কোন চমক থাকে না। উঠে উঠে করেও বিছানা ছেড়ে ওঠা যায় না ।ওদিকে মোরগ ডাকে, কাক ডাকে ।ঠান্ডা বাতাস ভেদ করে ভেসে আসে আজানের সুমধুর ধ্বনি । আস্তে আস্তে কর্মব্যস্ত মানুষের ওঠা শুরু হয়।