মায়ের ভুমি আর মায়ের ভাষার প্রতি প্রেম মানব চরিত্রের সুকুমার বৃত্তিগুলোর অন্যতম। যে দেশের আলো বাতাসে আমাদের জীবন হয়েছে বিকশিত, আর যে ভাষার বর্ণালী ছড়া আমরা প্রতিনিয়ত প্রকাশ করছি আমাদের মনের ভাব, সেই মাতৃভূমির আর মাতৃভাষার প্রতি আমাদের প্রেম ভালোবাসা থাকায় স্বাভাবিক। আর তাই বহু ভাষাবিদ ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ যথার্থ বলেছেন, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা আমাদের কাছে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। ঐতিহ্যবাহী এ ভাষার আরেকটি পরিচয় বিপ্লবের ভাষা । স্লোগান, সংগ্রাম, আন্দোলন ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে এ ভাষা তার নিজ মর্যাদা ও পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছে। ভাষার জন্য রক্তপাতের ইতিহাস দুর্লভ। বাংলা ভাষায় সেই অবিস্মরণীয় ইতিহাসের রক্ত রঞ্জিত পথ অতিক্রম করে এসেছে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ স্বাধীনতা প্রাপ্তের পর এ ভাষা পেয়েছে রাষ্ট্রভাষা সর্বোচ্চ মর্যাদা। তাই সর্বস্তরের বাংলা ভাষার বিকাশ, শ্রী বুদ্ধি ও জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রসারের জন্য আজ প্রতিটি শিক্ষিত বাঙালি সচেতন।
মাতা যেমন তার স্নেহ সুধা দিয়ে সন্তানের মানসিক বিকাশ সাধন করে চলেন, মাতৃভূমি যেমন ফুল- ফল-শস্য -জল- আলো- হাওয়া দিয়ে মানুষকে লালন করে, তাকে দেয় তার অস্তিত্বের গৌরবময় পরিচয়, তেমনি মাতৃভাষাও মানুষের জন্য যোগায় অফুরন্ত প্রাণশক্তি। মাতৃভাষার মাধ্যমেই মানুষ প্রকাশ করে তার মনের যত ভাব -ভাবনা, স্বপ্ন- কল্পনা, আবেগ -অনুভূতি। ‘বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা’ _কবির এ বিশ্বাসের বাণী সকল জাতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।তাই আমাদের জাতীয় জীবনে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম।
আমরা বাঙালি। আমাদের মাতৃভূমির নাম বাংলাদেশ। এটি একটি স্বাধীন দেশ। দীর্ঘকাল পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকে বাঙালি জাতিকেও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এক ভয়াবহ সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ থেকে নয় মাস ব্যাপী এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় আমাদের চির-আকাঙ্খিত, প্রিয় স্বাধীনতা। ৩০ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার জন্য বাঙ্গালীকে দীর্ঘদিন স্বৈরাচারী পশ্চিমা শাসক চক্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হয়েছে।
বিভিন্ন ঋতুতে বাংলাদেশের সৌন্দর্য হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যময়। গ্রীষ্মের দাবদাহে মাঠে মাঠে খরার প্রচন্ড তার মধ্যেই দেখা যায় গাছে গাছে আম কাঁঠালের সমারোহ। ঝড়ের বিকেলে চারিদিকে হইচই পড়ে যায়। সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর পানির মাছগুলো থই থই করতে থাকে পানিতে। এ যেন এক অন্যরকম সৌন্দর্য। শরতের নির্মল আকাশ ঝকঝকে দিন গ্রাম যেন হেসে ওঠে। হেমন্তে গ্রাম বাংলা নেচে ওঠে নবান্নের আনন্দে। মাঠে মাঠে পাকা ধান, সোনালী ধানের বোঝা মাথায় করে কৃষকের বাড়ি ফেরা।
চাষীর উঠানে ধানের স্তূপ, গরুর মলন দেওয়া, খড়ের গাদা ,কৃষাণ বউয়ের ধান ঝাড়া, ঢেঁকিতে ধানকুটা, পিঠা তৈরি গ্রাম বাংলার সাধারণ দৃশ্য। শীতকালের হিম কুয়াশা ঢাকা প্রভৃতি, হাড়ি কোমরে ঝুলিয়ে ছেনি হাতে খেজুর গাছে বেয়ে ওঠে গাছি। উঠানের রোদে চাটাই পেতে কলরব করে বালক বালিকার মুড়িগুড়, ভাপা পিঠা অথবা কাঁচা রসের ক্ষীর খাওয়া, আর বসন্তকালে পলাশে শিমুলে লাল হয়ে জ্বলে ওঠা বন বাদাড়, ঘন পাতার আড়াল থেকে ডেকে ওঠা সুকন্ঠ কোকিল ইত্যাদি গ্রাম বাংলার শাশ্বত সৌন্দর্য
বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে অসংখ্য নদ নদী বয়ে চলেছে। তাই বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়। শৈশবের মাতৃভাষা বাংলায় আমাদের প্রথম বাক্য স্ফূর্ত হয়েছে। এ ভাষায় আমরা মনের ভাব প্রকাশ করতে পেরেছি। এ ভাষা লিখে, এ ভাষা পড়ে, এ ভাষায় কথা বলে আমরা যত আনন্দ লাভ করি, এমন আর কোন ভাষায় সম্ভব নয়। আর যে দেশের আলো বাতাসে লালিত-পালিত, নিজের অজান্তেই সে মা আর মাতৃভূমির ভালোবাসা আমাদের হৃদয়কে আকৃষ্ট করে, মাতৃভাষার মোহস্পর্শে সে ভালোবাসা আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আর এর উদ্বেলিত ভালবাসার নামই স্বদেশপ্রেম, মাতৃ প্রেমে যার শুরু, স্বদেশ প্রীতিতে যার সমাপ্তি।