মুক্তিযুদ্ধ রচনা

স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা যে গৌরবোধ করি, এ গৌরব অর্জনের পিছনে এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস বিদ্যমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে পাকিস্তানি স্বাধীন হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মানুষ তাদের অধিকার ফিরে পায়নি। পরিবর্তন আসেনি বাঙ্গালীদের জীবনে। ব্রিটিশের পর পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ। তারা প্রথম আঘাত হানে বাঙ্গালীদের মাতৃভাষার ওপর। সমগ্র পাকিস্তানে বাঙ্গালী সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পরও বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পশ্চিমা শাসকের একপেশে সিদ্ধান্ত আর বৈরী আচরণকে বাঙালিরা মেনে নিতে পারেনি। এর প্রতিবাদে তারা রাজপথে আসে।

শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত হয়। ক্রমে ক্রমে সারাদেশে ঝরে পড়ে আন্দোলন। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিহত হওয়ার পর নতুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন খাজা নাজিম উদ্দিন। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় এসে পূর্বসূরিদের অনুসরণে একমাত্র রাষ্ট্রভাষ হিসেবে উর্দুর কথাই বললেন। ফলে ভাষা আন্দোলন আরো জোরদার হয়ে এক তুমুল গণ আন্দোলনে রূপ লাভ করে। ১৯৫২ সালের ২০ শে ফেব্রুয়ারি থেকে মিছিল মিটিং শুভযাত্রা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ছাত্র জনতা তাও মেনে নেয়নি।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাঙালি ছাত্র জনতা মিছিল নিয়ে রাজপথে নামে। মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি বর্ষণ করলে নিহত হন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতসহ অনেকে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী আলোচনা নামে কালক্ষেপণ করতে থাকলে বাংলাদেশ এগিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের দিকে। এদেশের মানুষের মনে দানা বেঁধে উঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত বাংলাদের উপর ঝাঁপি পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড চলে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পূর্বে তিনি ওয়ারলেস বার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারপরে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধ ছিল সকল শ্রেণীর বাংলাদেশী মানুষের আদর্শ এবং নতুন দিনের পথপ্রদর্শক। একাত্তর এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজও মিশে আছে আমাদের জীবনে, আমাদের সাহিত্যে, সংগীতে, শিল্পকলায়, স্থাপত্যে আর ভাস্কর্য শিল্পে। মিশে আছে আমাদের সংস্কৃতিতে। একে আমরা প্রতিবছর অনুভব করি স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বুদ্ধিজীবী হত্যার দিবস ইত্যাদি স্মরণীয় দিবসের মধ্য দিয়ে। বহু আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয়েছে আমাদের বিজয়ের দিন। সফলতা পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল চেতনাকে সমুন্নত রাখতে প্রতিক্রিয়াশীলদের সম্পর্কে আমাদেরকে অধিকতর সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। তারা যাতে দেশ ও মানুষের কোন ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তাদের সব ষড়যন্ত্র ভেঙে দিয়ে সব বিরুদ্ধে কর্মকান্ড প্রতিহত করতে হবে। দেশ প্রেমিক, রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, কর্মকর্তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সব বিরোধ ও বিভক্তির ঊর্ধ্বে থেকে দেশের অগ্রগতি ও জনগণের কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচক যাদের ক্রমশ বৃদ্ধি পায় এবং দারিদ্র্যমুক্ত সুশিক্ষিত উন্নত দেশ গড়ে ওঠে সেজন্য একনিষ্ঠভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আমরা যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারব।

আমাদের নানা কর্মকাণ্ডে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ এবং প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বুদ্ধিজীবী ও হত্যা দিবস ইত্যাদি পালনের মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুজ্জ্বল রাখার জন্য গড়ে তোলা হয় নানা ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধ যাতে বাংলাদেশের মানুষের কাছে অবিসর্ণীয় হয়ে থাকে, সেজন্য নানা ধরনের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। এসব ভাস্কর্য পরবর্তী প্রজন্মের মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন ঘটাবে।