পৃথিবীর প্রত্যেকটা জাতির জীবনে এমন কতগুলো দিন আছে যার স্মৃতি কোনদিন ভোলা যায় না। আমাদের জাতীয় জীবনে তেমনি একটি স্মৃতিময় অমলিন দিন বিজয় দিবস বা ১৬ই ডিসেম্বর। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর এই দিনে আমাদের স্বাধীনতার বিজয় অর্জিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করে মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে। দিনটি বাংলাদেশে জাতীয় মর্যাদায় পালন করা হয় এবং এটি সরকারি ছুটির দিন। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে দিনটি আমাদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রতিবছর ১৬ই ডিসেম্বর জাতীয় মর্যাদার সাথে বাংলাদেশে বিজয় দিবস উদযাপিত হয়। এটি সরকারি ছুটির দিন। এই দিনের রাজধানী শহরকে সাজানো হয় নানা রঙ্গের আলো সজ্জা দিয়ে। সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি অফিসগুলোতে জাতীয় পতাকা উড়ানো হয়। জেলা শহর গুলো সেজে উঠে বিজয়ের আনন্দে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধে পুষ্প স্তবক অর্পণ করা হয়। নানা স্থানে হয় আলোচনা অনুষ্ঠান। কোন কোন বিদ্যালয়ে নানা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। খেলাধুলার ব্যবস্থা করা হয়। আবাসিক ভবন গুলোতেও জাতীয় পতাকা উড়ানো দেখে মনে হয় পতাকাটিও যেন বিজয়ের আনন্দে গর্বিত। এমনিভাবে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিজয় দিবস উদযাপিত হয়।
১৯৭১ সালে প্রায় ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। নয় রক্তক্ষরণ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই স্বাধীনতা এসেছে। এই স্বাধীনতা দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করে অর্জিত হয়েছে। শূন্য হয়েছে অগণিত মায়ের কোল। আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বিজয় তাদের কাছে অধিকতর ঋণী। এ ঋণ শোধ হবার নয়। স্বাধীনতা অর্জন করা যত কঠিন, বিজয়ের গৌরবকে ধরে রাখা তার চেয়ে আরো বেশি কঠিন।
মুক্তিযোদ্ধারা যে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছিলেন, তাদের সেই স্বপ্ন, আশা বাস্তবায়িত করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে আমরা রাজনৈতিক মুক্তি এবং স্বাধীনতা পেয়েছি বটে, প্রকৃতপক্ষে পরিপূর্ণ বিজয় আমাদের এখনো আসেনি। এদেশের অনেক মুক্তিযোদ্ধা আজ পঙ্গু ও অসহায়, অনেকে বিভিন্ন ব্যাধিতে ভোগে, বিনা চিকিৎসায় অনাহারে, অর্ধাহারে মারা যাচ্ছেন দেশের দরিদ্র, বিপন্ন লোকজন। তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত শ্রমিকেরা কাজ করেও উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাচ্ছে না। বিজয় দিবসের দাবি এসব মানুষের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করা। এর জন্যই তো তারা মা- বাবা, স্ত্রী -পুত্র, পরিজন ফেলে যুদ্ধ করেছে। তাদের জন্যই আমরা পেয়েছি এমন একটি আনন্দময় বিজয়ের দিন। এ বিজয়ের সুবাদে আজ আমরা অনেকেই নানা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি মর্যাদার আসনে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছাড়া আমাদের সাফল্য ছিল সুদূর পরাহত। কাজেই আমাদের জাতীয় জীবনে বিজয় দিবসের তাৎপর্য অপরিসীম।
যেকোনো বিজয় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, তার কাছেও আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক। আশা ছিল স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এদেশের মানুষ শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে যাবে উন্নতির দিকে। মধুময় হাসি ফুটবে মানুষের মুখে। শান্তিতে ভরে উঠবে দেশ। জীবনের মর্যাদা বাড়বে। কিন্তু আমাদের সেই প্রত্যাশার কোনটাই পূরণ হয়নি। বর্তমানে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি সরকার রয়েছে। তাদের কাছে দাবি আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং প্রত্যাশা যাতে পূরণ হয়, যাতে বিজয় দিবস সার্থকতা পায়। আর সরকারের পাশাপাশি সুন্দর লক্ষ্য নিয়ে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা- সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিজয় দিবস বা ১৬ই ডিসেম্বর একটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যময় দিন। আমাদের জাতীয় জীবনে দিনটি খুবই গৌরবের। একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এ বিজয় আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম। তাই বিজয় দিবসকে সার্থক করে তোলার জন্য দল- মত নির্বিশেষে সকলকে একযোগে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। তাহলে আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে গৌরবের অধিকারী হতে পারব এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন করাও সম্ভব হবে।