মানুষকে ভালোবাসা, মানুষের কল্যাণ করা এবং মানুষ হিসেবে মানুষকে মর্যাদা দেওয়ার ঐকান্তিক ও কার্যকর বুদ্ধি হলো মানবিক মূল্যবোধ। জন্মের মধ্যে দিয়ে কোন মানব সন্তান মানুষে পরিণত হতে পারে না। তাকে নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিল তিল করে মানবিক বোধ অর্জন করতে হয়। মানুষের মানুষের প্রেম- ভালোবাসা, সহযোগিতা- সহানুভূতি, সৌহার্দ্য- সম্প্রীতি তৈরীর মাধ্যমে মানব মূল্যবোধ পরিপুষ্টি হয়। আর তা যখন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের চিন্তায় আচার-আচরণে প্রেরণা ও কর্মের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে কার্যকর হয়, তখনই মানবিক মূল্যবোধ উচ্চারিত হয় হৃদয় জুড়ে এবং মানুষ প্রকৃত মানুষ অভিধায়ক অভিষিক্ত হয়।
মূল্যবোধ হলো সার্বিক ব্যক্তিত্বের প্রভাব যার উপস্থিতি মানুষের রক্তম পর্যায়ে চিন্তা চেতনায়, ঐতিহ্য- সংস্কৃতিতে ও প্রয়োগ কর্মকাণ্ড এসবের মার্জিত পরিসীলতা বিশুদ্ধ ও লালন ও পালনযোগ্য। মানবিক মূল্যবোধ হল মনুষত্ববোধ তথা মানবিকতার সাথে সংশ্লিষ্ট উপাদান গুলোর মার্জিত, পরিশুদ্ধ ও বিশুদ্ধ উপস্থাপন ও রুপায়ন। মানবিক মূল্যবোধ দীর্ঘকালের ধারনকৃত লালিত অনুভূতি ও বিষয়। যা একক ও সমষ্টিগতভাবে আজও প্রবাহমান। সামাজিক পরিবর্তন বা বিবর্তনের ধারায় মানবিক মূল্যবোধের তেমন কোন মৌলিক পরিবর্তন না হলেও আচরিত কর্মকাণ্ডে তার কিছুটা অনিবার্য পরিবর্তন সূচিত হয়েছে।
মানবিকতার সাথে মূল্যবোধের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ। কেননা মানুষের সাথে মানবিকতার সংশ্লিষ্টতা যেমন অবিচ্ছিন্ন, তেমনি মানবিকতার সাথে মূল্যবোধের ঘনিষ্ঠতা অবিচ্ছিন্ন। মানবতা ও মূল্যবোধ একে অপরের পরিপূরক। একটাকে ছাড়া অন্যান্য অপরিপূর্ণ্য। মানবিকতা আচরণ ও কর্মে কার্যকর করার বিষয়ে আর মূল্যবোধ ধারন, লালন ও আচরণ প্রকাশ করার বিষয়। মানবিকতার প্রকাশ চোখে দেখা যায়, অনুভব করা যায়, সন্তুষ্ট হওয়া যায়, দৃষ্টান্তের মধ্যে সঞ্চালিত করা যায়। কিন্তু মূল্যবোধ অনুভব করতে হয়, প্রকাশ করতে হয়, অনুভব ও আত্মস্থ করার মাধ্যমে মূল্যবোধ অন্য হৃদয়ে আপনা আপনি সঞ্চারিত হয়। এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মূল্যবোধ সঞ্চালিত হয়েছে। আর মানবিকতার সুদীঢ় যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে।
পরিবার গঠন থেকে শুরু থেকে বিশ্ব মানবতা ও মূল্যবোধের রূপান্তরিত হয়েছে। কেননা পারস্পারিক সহানুভূতি- সহযোগিতা -সহমর্মিতা ছাড়া পরিবার তথা সমাজ গঠনের কথা আসেনি। একই সাথে পারস্পরিক স্নেহ- মমতা ও প্রেম -ভালবাসা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের চিন্তা চেতনা থেকে মানবিক সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক উচ্চারণ ঘটেছে। মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলার চিন্তা-চেতনা অনুভূতি মূল্যবোধ অর্থাৎ মূল্যবোধের উপরে গড়ে উঠেছে মানবিকতা ও কার্যকর হয়েছে। দেখে দেখে, শুনে শুনে, অনুভব করে করে তার হৃদয় থেকে হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়েছে।
লিখিতভাবে এর রুপায়ন ঘটেছে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় এবং রাষ্ট্রের নির্দেশনায়। অধিকার হিসেবে মানবিকতার প্রাচীনতম ধারণা পাওয়া যায় বৌদ্ধ ধর্ম ও সাহিত্যে। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ বছরের আগে ব্যাবিলনের রাজা হামবুরাবির নিয়মাবলীতে, এরপর সপ্তম শতকে মদিনার বহু ধর্মভিত্তিক সমাজের প্রেক্ষাপটে হযরত মুহাম্মদ সাঃ কর্তৃক প্রণীত মদিনা সনদে। পরবর্তীকালে রুশো, হুগো, জনলক, কার্ল মার্কস প্রমুখ মনীষীর রচনায়।
মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষের চিন্তা ও অনুভূতিতে মানুষের কল্যাণ বা সেবায় হবে মুখ্য। কিন্তু কারো মধ্যে যদি মানবিক মূল্যবোধ অনুপস্থিত থাকে, তাহলে সে মানুষ হয়ে উঠবে বর্বর ও পশু। তার মধ্যে তার সুন্দর ও পবিত্র দিকগুলো ঢাকা পড়ে যাবে। ফলে জন্ম নেবে সাম্প্রদায়ের কথা। বর্ণ বৈষম্য ও জাতিভেদ প্রসার লাভ করবে। হানাহানি, যুদ্ধবিগ্রহ, অনাদকতা ও বিশৃঙ্খলা। শান্তি ও নিরাপত্তার অভাবে মানবিক বোধগুলোর অভাবে মানুষের একটুখানি স্বস্তির জন্য মারাত্মক নেশা অথবা মৃত্যুকে বেছে নেবে।
মানবিক মূল্যবোধহীন একশ্রেণীর মানুষ মাদকদ্রব্যের ব্যাপক প্রসার ও মারাত্মক অস্ত্র প্রতিযোগিতার সুযোগে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করবে। ফলে মানবিক মূল্যবোধ-মৃত মানুষ এসবের বিভিন্ন শিকার ও পরিণত হবে। আধুনিক পৃথিবীর একদিকে যেমন মানবতার রক্ষা করা কঠিন, তেমন অন্যদিকে মানবিক মূল্যবোধের চর্চাও কঠিন।এ কঠিন অবস্থায় মানবিক মূল্যবোধ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন।