বাংলাদেশ। এই প্রকৃতি যেমন আমাদের আশ্রয় দিয়েছে, তেমনি আবার কখনো কখনো এই প্রকৃতি আমাদের আশ্রয় ধ্বংস করে। প্রকৃতির এই নির্মম রূপটিকে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ নামে নামকরণ করেছি। ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ুর কারণে আমাদের প্রায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে তীব্রতা, ব্যাপকতার কারণে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশ ও জাতির উন্নয়নের ধারা বিঘ্নিত হয় এবং পরিবেশের শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব।
প্রায় প্রতি বছরই এই দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, টর্নেডো, ভূমিকম্প, খরা, নদী ভাঙ্গন, শিলা বৃষ্টি প্রভৃতি এদেশের প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বন্যা বাংলাদেশের প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ছোটখাটো প্লাবনকে আমরা বলি বর্ষা। আর সেই প্লাবন যখন বিশাল আকার ধারণ করে তখন তাকে বলা হয় বন্যা। প্রায় প্রতিবছর বাংলাদেশে বন্যা দেখা দেয়। ভৌগলিক অবস্থান, অতি বৃষ্টিপাত, ভূতাত্ত্বিক কাঠামো, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, একই সময়ে প্রধান নদী সমূহে পানি বৃদ্ধি, নদীতে পলম সঞ্চয়, পানি নিষ্কাশনে বাধা প্রভৃতি বন্যার প্রধান কারণ। ১৯৮৮ সালের বন্যা ছিল বাংলাদেশের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। এ বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি কাটে ওঠা বাংলাদেশের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ফসলের। বন্যার কারণে হাজার হাজার কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়। রাস্তাঘাট ডুবে যার কানে ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। বন্যার সময় মানুষের বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। বন্যার পানির কারণে মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষিত হয়।
বাংলাদেশের ভৌগলিক আয়তন সীমিত। সীমিত আয়তনের একটি দেশে নদী ভাঙ্গন এক মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আমাদের দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে নদী ভাঙ্গন চলছে। বড় নদীর তীরবর্তী মানুষের জীবনে নদী ভাঙ্গন নিয়ে আসে সীমাহীন দুঃখ যন্ত্রণা। নদীর পানির প্রবাহপথ সংকুচিত হওয়ার কারণে স্রোতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়া, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন এবং নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে বড় নদীগুলোতে নদী ভাঙ্গন চলছে। নদী ভাঙ্গনের ফলে আমাদের দেশে প্রতিবছর ২০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নদী ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভূমিকম্পও বহু শতাব্দী ধরে বাংলাদেশে আঘাত হানছে। বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল হলো ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। লবণাক্ততাও একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী জমিতে প্রায়ই লবণাক্ততা দেখা দেয়। এর ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
শিলা বৃষ্টি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ গুলোর একটি। প্রায় প্রতিবছরই এ দেশে ব্যাপক শিলাবৃষ্টি হয়। শিলাবৃষ্টির কারণে বিভিন্ন প্রকার ফসলের অনেক ক্ষতি হয়। বিশেষ করে ইরি ধানের মৌসুমের শিলাবৃষ্টি হলে কৃষকের দুঃখ-দুর্দশার সীমা থাকে না। চারা অবস্থায় শিলাবৃষ্টি হলে ধানের ফসল অনেক কম হয়। ধান বের হওয়ার পর শিলাবৃষ্টি হলে ধান চিটা হয় এবং ঝরে যায়। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে অতিবৃষ্টির ক্ষতির দিক কম নয়। বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই অতিবৃষ্টির প্রকোপ দেখা দেয়। অতি বৃষ্টির ফলে জমি পানিতে ডুবে যায় এবং জমি থেকে পানি নিষ্কাশন দেরিতে হয়। এর ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে।
প্রকৃতির বিশালতার কাছে মানুষ অসহায়। মানুষ প্রকৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার করতে না পারলেও প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মানুষের সৃষ্ট কর্মকান্ডের জনক প্রকৃতি রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রেহাই পেতে হলে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে সর্বাগ্রে। এজন্য প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। দুর্যোগ সবসময়ই মানবতার জন্য বিপদ ডেকে আনে। তাই যেকোনো দুর্যোগের সময় আর্ত মানবতার সেবায় হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ সরকার অনেক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।